ব্যাপক সংঘর্ষে দেশ অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছিল সেদিন

সংগৃহীত ছবি

 

অনলাইন ডেস্ক :  ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট—দেশের ইতিহাসে এক ভয়াবহ ও রক্তাক্ত দিন। সেদিন সরকারের বিরুদ্ধে চলা অসহযোগ আন্দোলনের বিপরীতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠন যুবলীগ ও ছাত্রলীগ অস্ত্র হাতে রাস্তায় নামে। চারপাশে সংঘর্ষ, গুলি, টিয়ারশেল আর মৃত্যু; গোটা দেশ যেন পরিণত হয় এক বিশাল যুদ্ধক্ষেত্রে।

 

সরকার পতনের দাবিতে চলমান অসহযোগ আন্দোলনের প্রেক্ষিতে এই দিনটি অভ্যুত্থানের ইতিহাসে মোড় ঘোরানো এক অধ্যায় হয়ে ওঠে। আন্দোলনকারীরা তখন ‘এক দফা, সরকার পতন’ দাবিতে রাজপথে ছিল। কিন্তু সে দাবির জবাবে রাষ্ট্রযন্ত্রের শক্তি ব্যবহার করে আন্দোলন দমন করতে উদ্যত হয় তৎকালীন স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার সরকার।

জুলাইয়ের ৩৫তম দিন (৪ আগস্ট), সকাল থেকেই রাজধানী ঢাকায় শুরু হয় উত্তেজনা। দুপুর গড়াতে না গড়াতেই শুরু হয় সংঘর্ষ। একের পর এক টিয়ারশেল, সাউন্ড গ্রেনেড, রাবার বুলেট আর সরাসরি গুলির আওয়াজে কেঁপে উঠে শহর। প্রতিরোধহীন সাধারণ জনতার ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে সরকারি বাহিনী ও ক্ষমতাসীনদের কর্মীরা।

 

সেদিন রাজধানীর প্রায় প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। ঢাবি, শাহবাগ, পল্টন, গুলিস্তান, ধানমন্ডি, মতিঝিল, মিরপুর—প্রতিটি এলাকায় বিক্ষোভকারীদের ওপর চালানো হয় আগ্নেয়াস্ত্রের হামলা। সিভিল পোশাকে থাকা লোকজনের হাতেও ছিল অস্ত্র। আন্দোলনকারী ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, দিনভর গুলিতে নিহত হন শতাধিক মানুষ।

 

আহত হন হাজার হাজার মানুষ, অনেকের দেহ খোঁজও মেলেনি এখনো। পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার সারা দেশে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি করে। একইসঙ্গে ঘোষণা দেয় তিন দিনের সাধারণ ছুটি।

 

আওয়ামী লীগ সরকার এ আন্দোলনকে ‘জঙ্গি হামলা’ বলে আখ্যায়িত করে। দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা সংবাদ সম্মেলন করে জানান, তারা রাজপথ থেকে ‘জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের’ নির্মূল না করা পর্যন্ত মাঠ ছাড়বেন না। ছাত্রলীগ-যুবলীগের হাজার হাজার কর্মীকে দেশজুড়ে অস্ত্র ও লাঠিসোঁটা হাতে রাজপথে দেখা যায়।

সেদিন সন্ধ্যায় এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, তারা আন্দোলনে একাত্মতা প্রকাশ করছেন। তিনি বিএনপির সব স্তরের নেতাকর্মীদের অসহযোগ আন্দোলনে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানান এবং বলেন, গণহত্যাকারী স্বৈরাচার সরকারের পতন ত্বরান্বিত করতে আমাদের সবাইকে রাজপথে থাকতে হবে।

 

এই ঘটনার পর জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশনার ফলকার তুর্ক এক বিবৃতিতে বাংলাদেশে চলমান বেদনাদায়ক সহিংসতা অবিলম্বে বন্ধের আহ্বান জানান।

 

অন্যদিকে সেনাবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তারা বিবৃতি দিয়ে অনুরোধ জানান, সশস্ত্র বাহিনী যেন ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে ব্যবহৃত না হয়। তারা বলেন, এই জাতির ভবিষ্যৎ ধ্বংস করা যাবে না। সেনাবাহিনীর উচিত নিজেকে জনগণের প্রতিপক্ষ না বানানো।

 

ভয়াবহ দিনটির মধ্যেই আসে আরও একটি বড় ঘোষণা—‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচির তারিখ এক দিন এগিয়ে আনা হয়।

 

আন্দোলনের শীর্ষ নেতা আসিফ মাহমুদ ভিডিও বার্তায় বলেন, জরুরি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী লং মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচি এক দিন এগিয়ে আনা হয়েছে। ৬ আগস্ট নয়, ৫ আগস্টই হবে চূড়ান্ত গণজোয়ার। সারাদেশ থেকে মুক্তিকামী জনতাকে ঢাকায় পৌঁছাতে হবে এখনই।

 

আরেক শীর্ষ সমন্বয়ক সারজিস আলম তার ফেসবুকে লিখেন, পরশু নয়, কালকেই লং মার্চ টু ঢাকা!

 

সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, আগামীকালই ‘মার্চ টু ঢাকা’। ইতিহাসের সাক্ষী ও চূড়ান্ত লড়াইয়ে শামিল হতে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করুন এখনই। এই ঘোষণা নতুন করে উজ্জীবিত করে আন্দোলনকারীদের। বলা চলে, ৪ আগস্টের গণহত্যার পরদিনই ছিল বিজয়ের টার্নিং পয়েন্ট।

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» র‌্যাংকিংয়েও আফগানদের টপকে গেল টাইগাররা

» রাজাকারের নাতিপুতি আখ্যা দেওয়া শিক্ষার্থীদের জন্য ছিল অপমানজনক

» নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে মানুষ পছন্দের প্রার্থীকে বেছে নেবে: টুকু

» রাতারগুলের অবকাঠামো উন্নয়নে সরকার পাশে থাকবে: আসিফ নজরুল

» প্রধান উপদেষ্টা জাতিসংঘে যাচ্ছেন ৪ রাজনীতিবিদকে নিয়ে

» এবারের দুর্গাপূজা উৎসবমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হবে: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

» দুর্গাপূজায় আমাদের সর্বোচ্চ সতর্ক ও প্রতিরোধের প্রস্তুতি থাকতে হবে: তারেক রহমান

» পিআর দাবি জনগণের আঙ্খাকার সঙ্গে ‘মুনাফেকি’: রিজভী

» পূজামণ্ডপের নিরাপত্তায় অতন্দ্র প্রহরী হোন: নেতা-কর্মীদের মির্জা ফখরুল

» সফররত ইইউ প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বিএনপির বৈঠক

  

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

ব্যাপক সংঘর্ষে দেশ অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছিল সেদিন

সংগৃহীত ছবি

 

অনলাইন ডেস্ক :  ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট—দেশের ইতিহাসে এক ভয়াবহ ও রক্তাক্ত দিন। সেদিন সরকারের বিরুদ্ধে চলা অসহযোগ আন্দোলনের বিপরীতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠন যুবলীগ ও ছাত্রলীগ অস্ত্র হাতে রাস্তায় নামে। চারপাশে সংঘর্ষ, গুলি, টিয়ারশেল আর মৃত্যু; গোটা দেশ যেন পরিণত হয় এক বিশাল যুদ্ধক্ষেত্রে।

 

সরকার পতনের দাবিতে চলমান অসহযোগ আন্দোলনের প্রেক্ষিতে এই দিনটি অভ্যুত্থানের ইতিহাসে মোড় ঘোরানো এক অধ্যায় হয়ে ওঠে। আন্দোলনকারীরা তখন ‘এক দফা, সরকার পতন’ দাবিতে রাজপথে ছিল। কিন্তু সে দাবির জবাবে রাষ্ট্রযন্ত্রের শক্তি ব্যবহার করে আন্দোলন দমন করতে উদ্যত হয় তৎকালীন স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার সরকার।

জুলাইয়ের ৩৫তম দিন (৪ আগস্ট), সকাল থেকেই রাজধানী ঢাকায় শুরু হয় উত্তেজনা। দুপুর গড়াতে না গড়াতেই শুরু হয় সংঘর্ষ। একের পর এক টিয়ারশেল, সাউন্ড গ্রেনেড, রাবার বুলেট আর সরাসরি গুলির আওয়াজে কেঁপে উঠে শহর। প্রতিরোধহীন সাধারণ জনতার ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে সরকারি বাহিনী ও ক্ষমতাসীনদের কর্মীরা।

 

সেদিন রাজধানীর প্রায় প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। ঢাবি, শাহবাগ, পল্টন, গুলিস্তান, ধানমন্ডি, মতিঝিল, মিরপুর—প্রতিটি এলাকায় বিক্ষোভকারীদের ওপর চালানো হয় আগ্নেয়াস্ত্রের হামলা। সিভিল পোশাকে থাকা লোকজনের হাতেও ছিল অস্ত্র। আন্দোলনকারী ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, দিনভর গুলিতে নিহত হন শতাধিক মানুষ।

 

আহত হন হাজার হাজার মানুষ, অনেকের দেহ খোঁজও মেলেনি এখনো। পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার সারা দেশে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি করে। একইসঙ্গে ঘোষণা দেয় তিন দিনের সাধারণ ছুটি।

 

আওয়ামী লীগ সরকার এ আন্দোলনকে ‘জঙ্গি হামলা’ বলে আখ্যায়িত করে। দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা সংবাদ সম্মেলন করে জানান, তারা রাজপথ থেকে ‘জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের’ নির্মূল না করা পর্যন্ত মাঠ ছাড়বেন না। ছাত্রলীগ-যুবলীগের হাজার হাজার কর্মীকে দেশজুড়ে অস্ত্র ও লাঠিসোঁটা হাতে রাজপথে দেখা যায়।

সেদিন সন্ধ্যায় এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, তারা আন্দোলনে একাত্মতা প্রকাশ করছেন। তিনি বিএনপির সব স্তরের নেতাকর্মীদের অসহযোগ আন্দোলনে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানান এবং বলেন, গণহত্যাকারী স্বৈরাচার সরকারের পতন ত্বরান্বিত করতে আমাদের সবাইকে রাজপথে থাকতে হবে।

 

এই ঘটনার পর জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশনার ফলকার তুর্ক এক বিবৃতিতে বাংলাদেশে চলমান বেদনাদায়ক সহিংসতা অবিলম্বে বন্ধের আহ্বান জানান।

 

অন্যদিকে সেনাবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তারা বিবৃতি দিয়ে অনুরোধ জানান, সশস্ত্র বাহিনী যেন ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে ব্যবহৃত না হয়। তারা বলেন, এই জাতির ভবিষ্যৎ ধ্বংস করা যাবে না। সেনাবাহিনীর উচিত নিজেকে জনগণের প্রতিপক্ষ না বানানো।

 

ভয়াবহ দিনটির মধ্যেই আসে আরও একটি বড় ঘোষণা—‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচির তারিখ এক দিন এগিয়ে আনা হয়।

 

আন্দোলনের শীর্ষ নেতা আসিফ মাহমুদ ভিডিও বার্তায় বলেন, জরুরি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী লং মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচি এক দিন এগিয়ে আনা হয়েছে। ৬ আগস্ট নয়, ৫ আগস্টই হবে চূড়ান্ত গণজোয়ার। সারাদেশ থেকে মুক্তিকামী জনতাকে ঢাকায় পৌঁছাতে হবে এখনই।

 

আরেক শীর্ষ সমন্বয়ক সারজিস আলম তার ফেসবুকে লিখেন, পরশু নয়, কালকেই লং মার্চ টু ঢাকা!

 

সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, আগামীকালই ‘মার্চ টু ঢাকা’। ইতিহাসের সাক্ষী ও চূড়ান্ত লড়াইয়ে শামিল হতে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করুন এখনই। এই ঘোষণা নতুন করে উজ্জীবিত করে আন্দোলনকারীদের। বলা চলে, ৪ আগস্টের গণহত্যার পরদিনই ছিল বিজয়ের টার্নিং পয়েন্ট।

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



  

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

Design & Developed BY ThemesBazar.Com